বি.এম.আই (B.M.I)
পরিপূর্ণ নাম "Body Mass Index" বা "দেহের ওজন সূচক।"
একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দেহের ওজন মাত্রাতিরিক্ত কিনা তা নির্ণয়ের জন্য উচ্চতা ও ওজনের যে আনুপাতিক হার উপস্থাপন করা হয় তাকে বি.এম.আই বলা হয়।
মূলত,শরীর-স্বাস্থ্য কোন অবস্থায় আছে তা বোঝার জন্য দু'টো পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।
১.সঠিক ওজন নির্ণয়
২.বি.এম.আই নির্ণয়
প্রথমটি নির্ণয় অপেক্ষাকৃত সহজ। আদর্শ ওজন এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে। আদর্শ ওজন হচ্ছে সেটাই যেখানে ব্যক্তির উচ্চতার তুলনায় ওজন কতখানি আছে তার পরিমাপ।
নির্ণয়ের সূত্রটি হচ্ছে-
আদর্শ ওজন= উচ্চতা(সে.মি)-১০০
উদাহরণস্বরূপ,কারো উচ্চতা ৫'৫"=৬৫"=৬৫×২.৫৪ সে.মি=১৬৫.১ সে.মি [যেহেতু,১"=২.৫৪ সে.মি]
সুতরাং,আদর্শ ওজন= ১৬৫.১-১০০= ৬৫.১ কিলোগ্রাম
সূত্রটি প্রয়োগ করে যদি কোনো ব্যক্তির আদর্শ ওজন আর মাপার পর প্রাপ্ত ওজনে বেশখানেক পার্থক্য ধরা পড়ে,তখন বুঝতে হবে ঐ ব্যক্তির শারীরিক ভারসাম্যহীনতা আছে।
তবে এ পদ্ধতিটি শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্ক অর্থাৎ ১৮ বছরের বেশি হলেই প্রয়োগ করা যাবে।
ওজনের ব্যাপার তো গেলো।
সঠিকভাবে ওজন নির্ণয় দ্বারা স্বাস্থ্য স্বাভাবিক অবস্থায় আছে কি না তা বোঝা গেলেও যদি ফলাফলের পার্থক্য খুব বেশিই হেরফের হয় তখন স্বাস্থ্য টা আসলেই কোন পর্যায়ে আছে তা নির্ণয়ের জন্য বি.এম.আই প্রয়োগ করতে হয়।
সূত্রটি হলো-
বি.এম.আই= কেজি'তে ব্যক্তির ওজন÷মিটারে ব্যক্তির উচ্চতা²
ধরা যাক,কোনো ব্যক্তির ওজন ৭০ কেজি এবং উচ্চতা ৫'৭"
এ ক্ষেত্রে প্রথমেই উচ্চতাকে মিটারে রূপান্তরিত করতে হবে।
৫'৭"= ৬৭"= ৬৭×২.৫৪ সে.মি = ১৭০.১৮ সে.মি= ১.৭ মিটার
সুতরাং,বি.এম.আই= ৭০÷১.৭²
= ২৪.২২
এ সূত্রটি সর্বাধিক ব্যবহৃত হলেও এ পদ্ধতি ব্যতীত আরেকভাবেও মাপা যায়। সে ক্ষেত্রে ওজনকে পাউন্ড আর উচ্চতাকে ইন্ঞ্চিতে ধরা হয়।
বি.এম.আই গণনার পরবর্তী কাজই হলো ফলাফলটি তালিকার সাথে মিলিয়ে দেখা এবং ব্যক্তির স্বাস্থ্য কোন পর্যায়ে আছে তা নির্ণয় করা।
বি.এম.আই ক্যাটাগরি
-------------- ------------
<১৮.৫০ ওজনহীনতা
১৮.৫-২৪.৯ স্বাভাবিক
২৫.০-২৯.৯ ওজনাধিক্য
৩০.০-৩৯.৯ স্হূলতা
>৪০.০ চূড়ান্ত স্হূলতা
যদিও এক এক দেশে বি.এম.আই এর চার্ট এক এক রকম হয়,কেননা ভৌগলিক পরিবেশ,খাদ্য গ্রহণ,দেহাকৃতি স্হানভেদে ভিন্ন হয়।
বলে রাখা ভালো যে,এ ক্ষেত্রেও উপর্যুক্ত তালিকাটি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রযোজ্য।
শিশুদের ক্ষেত্রে (২-২০ বছর) একই সূত্র প্রয়োগ হলেও স্বাস্থ্যের পর্যায় নির্ণয়ের তালিকাটি ভিন্ন। একটি নির্দিষ্ট সীমার ভেতর শতকরা হারের মাধ্যমে সাধারণত নির্ণয় করা হয়। শতকরা হার ৫% এর নিচে হলে ওজনহীনতা,৫-৮৫% হলে স্বাভাবিক,৮৫-৯৫% হলে ওজনাধিক্য এবং ৯৫% এর বেশি হলে স্থূলতা।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বি.এম.আই এর পাশাপাশি কোমর ও নিতম্বের মাপের অনুপাত দিয়েও স্থূলতা নির্ণয় করা হচ্ছে।
আদর্শ অনুপাত= কোমরের মাপ(সে.মি)÷নিতম্বের মাপ(সে.মি)
আদর্শ ফলাফল:
পুরুষদের ক্ষেত্রে <০.৯
মহিলাদের ক্ষেত্রে <০.৮
প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ: ১৯৮০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৩৩ বছরের পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, ১৯৮০সালে ৭% প্রাপ্তবয়স্ক এবং ৩% শিশু ওজনাধিক্য বা স্হূলতায় আক্রান্ত হলেও ২০১৩ সালে তা দাঁড়ায় ১৭% প্রাপ্তবয়স্কে কিন্তু ৪.৫% শিশুতে। দেখা যাচ্ছে যে,স্হূলতা ২% থেকে ৪% এ বেড়ে দাড়িয়েছে প্রাপ্তবয়স্কদের;অন্যদিকে তা শিশুদের ক্ষেত্রে ১.৫%
অর্থ্যাৎ,প্রাপ্তবয়স্করা শিশুদের তুলনায় দিন দিন অধিক আক্রান্ত হচ্ছেন।
দেখা যাক কারণগুলো-
১. কায়িক পরিশ্রম না করা,একটানা বসে থেকে কাজ করা।
২.অপরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য গ্রহণ না করা,চর্বিযুক্ত ও চিনিযুক্ত খাদ্য গ্রহণ,অ্যালকোহল পান।
৩. বিষন্নতা,আশাহীনতা,রাগ কিংবা একঘেয়েমিতে অতিভোজন।
৪. নিদ্রাহীনতায় হরমোনজনিত পরিবর্তনে ক্ষুদাগ্রতা বাড়ায় অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহন।
৫. বংশগত কারণেও স্হূলতার সৃষ্টি হয়।
৬. পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম,কুসিং সিনড্রোম,হাইপারথায়রয়েডিজমে আক্রান্ত হলে স্হুূলতা দেখা দেয়।
৭. অ্যান্টিডিপ্রেজেন্টস কিংবা জন্মবিড়তিকরণ বড়িও স্হূলতার কারণ।
৮. সুস্বাস্থ্য এবং সুষম খাদ্য সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব।
বি.এম.আই এর বিভিন্ন অবস্থার ফলাফল:
বি.এম.আই অতি কম হলে ওজনহীনতার সৃষ্টি হয়। ফলে রুগ্নতা,চেহারায় বলিরেখা,রক্তশূণ্যতা,শারীরিক দূর্বলতা,চর্মরোগ,চুল পড়া,দাঁত নস্ট হয়ে যাওয়া এবং হাড়ের ক্ষয় ঘটে।
আবার,বি.এম.আই অত্যধিক হলে ওজনাধিক্য কিংবা স্হূলতা সৃষ্টি হয়। ফলে হৃদরোগ,ডায়াবেটিস,স্তন ও কোলন ক্যান্সার,উচ্চ রক্তচাপ,স্ট্রোক,ডিজলিপিডেমিয়া,শ্বসনতন্ত্র-যকৃত-পিত্তথলির অসুখ এবং বন্ধ্যাত্ব দেখা দেয়।
মূলত চর্বির কারণেই স্হূলতার সৃষ্টি। পেটে,নিতম্বে,কোমরে চর্বিকোষ বেশি থাকে। তবে চর্বির বিতরণের উপর নির্ভর করে ঝূঁকিপূর্ণতা নির্ণয় করা যায়। দেহের আকার আপেল আকৃতির হলে তা অধিক ঝূঁকিপূর্ণ অন্যদিকে নাশপাতি আকৃতির হলে কম ঝূঁকিপূর্ণ। দেহের অন্যান্য অংশের তুলনায় পেটে জমাকৃত চর্বি (সেন্ট্রাল এদিপসিটি) অনেক বেশি বিপদজনক।
প্রতিকার: সুষম খাদ্য গ্রহণ,নিয়মিত ব্যায়াম,আবেগ নিয়ন্ত্রণ,কায়িক পরিশ্রম এবং পরিপূর্ণ নিদ্রা-ই যথেষ্ট স্হূলতা দূর করতে।
অনেক সময় দেখা যায় যে,সঠিক পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করলেও ওজনাধিক্যের সৃষ্টি হচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে,যে পরিমাণ ক্যালরি দেহ গ্রহণ করছে সে পরিমাণ খরচ করছেনা। ফলে মেদ জমা হচ্ছে। আবার অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ করেও দেহের রুগ্নতা সারছে না। এর কারণ হচ্ছে,দেহের যে পরিমাণ ক্যালরি দরকার সে পরিমাণ পাচ্ছেনা। এমতাবস্থায়,চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
তবে নিয়মমাফিক জীবনযাপন করলে স্বাভাবিকভাবেই ফিটনেস বজায় রাখা যায়। মনে রাখতে হবে,
"স্বাস্থ্য সকল সুখের মূল নয়,সু-স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল।"
লেখকঃ মুয়িদুল ইসলাম সিফাত
Green Life Medical College and Hospital
Dhaka-1205,Bangladesh
Batch: GMC-7