আমি মধ্যবিত্ত


হ্যাঁ,আমি মধ্যবিত্ত।

মধ্যবিত্ত বলেই তোমার সন্তানকে পড়িয়ে নিজের হাত-খরচা জোগাড় করি। মধ্যবিত্ত বলেই ক্রোশ পথ পায়ে হেঁটে টিউশনিতে যাই। কেননা মধ্যবিত্তের ঘরে পকেটমানি চাইতে বুকে বাঁধে।

বাদ দিলাম পকেটমানি। বয়স তো হয়েছে ভালোই। আমারও তো পরিবারকে কিছু দিতে ইচ্ছে করে। বাবার পান্জাবী,মায়ের শাড়ি টা নতুন করে দেখতে ইচ্ছে করে।

তুমি তো বড়লোক। সন্তানকে বড় বড় স্কুল-কলেজে পড়াও। তোমার এত দীনতা কেনো?

তোমারই একটা গল্প শুনবে? শোনো।

মাস চারেক আগে তোমার মেয়েকে পড়াতে বললে। তোমায় আমি চিনিনা। আমায় বললে,তোমার তেমন কিছু নেই। তোমার মেয়ে ভিকারুন্নিসার সেকেন্ড গার্ল। খুবই ব্রিলিয়ান্ট। সপ্তম শ্রেণী। হাতে তখন এস.এস.সি বা এইচ.এস.সি কোনোটারই ছাত্র নেই। টিউশনিহীনতার কারণে তোমার বাচ্চাকে পড়াতে রাজি হলাম। মাত্র চার হাজার টাকায়। তুমি এর বেশি দিতে পারবেনা। কারণ,তোমার নাকি সামর্থ্য নেই।

সাড়ে চার কিলো পায়ে হেঁটে যেদিন তোমার বাসায় ঢুকলাম,দারোয়ানের কাছে জানতে পারলাম তুমি আর্কিটেকচার। এই আটতলা এ্যাপার্টমেন্ট তোমারই। প্রাডো আর মিতসুবিশি দুটো গাড়িই তোমার।

মেজাজ টা চড়ে গেলেও তোমায় কিছু বলতে পারি নি। কারণ,আমি হতবাক তোমার কৌশলে। লজ্জ্বা টা বেশি বলে হয়তো  মুখটা আজও খুলতে পারিনি।

প্রথমে পড়াতে বললে রাত আটটায়,দুদিন পর ন'টায়,আরও দুদিন পর দশটায়। কারণ,তোমার মেয়ে দশটার পর পড়তে বসতে চায় না। নিজের পড়া পড়ে,আরও কাজ করে তোমার বাসায় আসতে যেতে নয় কিলো পথ পাড়ি দিতে হতো।

আমি কি ছাত্র নই?আমি তোমায় বলা সত্ত্বেও রাজি হলেনা। আমাকে রাতেই যেতে হবে। পড়ানোর পরিমাণ বাড়াতে হবে,সময় বেশি দিতে হবে। কিন্তু তোমার অর্থ প্রদান বাড়েনি।

আমি পড়ানোর সময় তুমি পাশে এসে দাঁড়িয়ে থাকো। পাছে আমি পড়ানোয় ফাঁকি দেই। ঘর্মাক্ত ব্যাচেলর ছেলেটির শুকনো মুখ দেখেও তোমার ঘরে কখনো পানির দেখা পাই নি। নাস্তা তো রাজার খরচ।

কানের সামনে রেডিও বাজাও,আরো বেশি সময় দেন। সাবজেক্ট বেশি। হপ্তায় পারলে পাঁচদিন আসেন,পরীক্ষা নেন বারবার। প্রশ্ন প্রিন্ট করে দেন। সিস্টেম বদলান বারবার যাতে পড়ায় মনোযোগ বাড়ে সন্তানের। কিন্তু তোমার বেতন প্রদানের সিস্টেম বদলায় নি। লজ্জ্বায় বলতেও পারিনা। মধ্যবিত্ত ছেলেদের লজ্জ্বা বোধহয় একটু বেশি ই।

শুধু তুমি না। তোমার মত হাজারে এরকম আরো দু-চারজন আছে। তোমারই সতীর্থ একবার নিজের সন্তানকে পাঁচদিন ছুটিতে রেখেছিলো। আবার সেই পাঁচদিনের ছুটি দাবিতে অর্ধমাসের বেতন দিয়েছিলো। কোন যুক্তিতে এ কাজ,আমি হতভম্বতায় আজও বুঝিনি। লজ্জ্বায় মুখে বুলি ফোটাতে পারিনি। পকেটটা অর্ধহালকা অনুভবে রাস্তায় হেঁটেছিলাম দীর্ঘক্ষণ।

এই শহরে নামী-দামী প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ভিড়ে টিউশনি পাওয়া খুব কঠিন। তারপরও টিউশনি খুঁজি। তুমিও কম টাকায় স্বার্থ হাসিলের জন্য আমার মত ছাত্রদের শিক্ষক হিসেবে রাখো।

শোনো অভিভাবক,কাকের ঘরে কাকই হয়,কোকিল হয় না। নিচু মানসিকতা বদলাও। কম খরচে সন্তানের ভালো রেজাল্ট আশা করা তোমার অন্যায়।
যে তোমার সন্তানকে পড়াচ্ছে,সে আমিও একজন ছাত্র। আমারও পড়াশোনা আছে,কাজ আছে,অন্য একটা রঙিন দুনিয়া আছে।

আমার মত হাজার ছাত্র নিজের জন্য তোমার মত হাজার অভিভাবকের সন্তানকে পড়াচ্ছে।

দয়া করে শিক্ষক নামক সেই ছাত্রের অসহায়ত্বের সুযোগ নিও না।

No comments:

Post a Comment

পোস্টটির দর্শক সংখ্যা-

ফিচার পোস্ট

দারুণ তিনটি টিনেজ মুভি

কৈশোরেতে প্রেমে না পড়লে বুড়ো বয়সে আপসোস করতে হয়। বয়ঃসন্ধির নতুন জগৎ,নতুন অনুভূতি,ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো পরবর্তীতে দারুণ স্মৃতি হয়ে আজীবন রয়ে যায়...

সর্বাধিক পঠিত