নীলচিত্রের বিবর্তন


-নীল ছবি কি?

-এইটা কোনো কথা..!! যেই ছবির রং নীল,তারেই নীল ছবি কয়। যেমন আকাশের ছবি,সাগরের ছবি হেন-তেন।

এখনকার জেনারেশনের কাছে নীল ছবি যতটা সহজলভ্য,আমাদের সময় সেইটা ছিলোনা বললেই চলে। বহুৎ দৌড়াদৌড়ি কইরা খায়েশ মিটাইতে হইতো।

নব্বইয়ের দশকে বাজারে সিডি আকারে পাওয়া যাইতো। ব্লু ফিল্মের সিডি। আমরা নানারকম সংকেতে ডাকতাম। ভূতের সিনেমা,বিজ্ঞাপন,বক্কর আরো কত কি..!!

একদিন এক বন্ধু কইলো,মামা,ভূতের সিনেমা দেখবি? দেখমুনা মানে? অবশ্যই..!! গিয়া দেখলাম সেইটা মডিফাইড ভুত। দরজা জানালা বন্ধ,রুদ্ধশ্বাসে ভুতের সিনেমা চলতেছিলো ভিসিআরে। কিন্তু মাঝপথে দরজায় টোকা পড়ে বন্ধুর বাপের। তরিঘরি কইরা টিভি আর ভিসিআর অফ করা হইলো,দরজাও খোলা হইলো কিন্তু সিডিটা বাইর করার কথা কারোরই মনে নাই।

- কি রে,দরজা জানলা বন্ধ কইরা সবাই কি করতাছোত?

- এইতো আব্বা,গল্প করি।

- এ্যামনে কেউ গল্প করে? দাঁড়া,তগোরে ভিসিআরে গান ছাইড়া দেই।

অতঃপর,বন্ধুর বাপের হাতে ভিসিআর অন,সুন্দর সুন্দর শব্দ এবং সবাই দৌড়াইয়া ঘর থেইকা বাইর হইয়া যাওয়া।
অলৌকিক ব্যাপার,সেই মুহূর্তে বন্ধু বড়ই চেস্টা করতেছিলো রিমোট দিয়ে ভিসিআর বন্ধ করার কিন্তু রিমোট কাজ করতেছিলোনা।

ওর বাপরে দেখছিলাম,কাঠের ডাসা লইয়া ঘরের ভেতরে ঢুকতে। আর কিছু জানিনা।

যখন হাই স্কুলে পড়ি তখন মাল্টিমিডিয়া সেট হাতে হাতে। সবার ব্যাগ কিংবা প্যান্টের চিপায়-চুপায় ফোন লুকায়িত থাকতো। স্যারেরা সেইসব ফোন ছিনতাইয়ের ধান্ধায় থাকতেন।

এর ওর কাছে দৌড়াদৌড়ি কইরা ব্লুটুথে ঘন্টার পর ঘন্টা লাগায়া তথ্য আদানপ্রদান চলতো।

তখন কম্পিউটার দোকানদারের ব্যবসা তুঙ্গে। বিশ-পঁচিশ টাকায় এক জিবি। বন্ধুমহলে যে যার থেইকা যত বেশি কালেকশন আর যত বেশি নায়ক-নায়িকার নাম মনে রাখতে পারে তার স্ট্যাটাস তত উপরে। আশিক বানায়ার মত গানও টু-এক্স এর সমপর্যায়ে ধরা হইতো।

একদিন এক বন্ধু ফোনসমেত ধরা খাইলো। স্যার ফোন নিয়া গেলেন। টিফিন পিরিয়ডে টিচার্স রুমে উঁকি দিয়া দেখি স্যার সেই ফোন হাতে কি জানি দেখতেছেন আর মিটমিটায়া হাসতেছেন।

সাইবার ক্যাফেগুলাতে পোলাপাইন ঢুকতো জোশ নিয়া,বাইর হইতো রুমাল দিয়া ঘাম মুছতে মুছতে। এমনও হইছে,একই ঘরের বড় ভাই ঘাম মুছতে মুছতে বাইর হইতাছে,পাশে তাকায়া দেখে ছোটভাইও ঘাম মুছতাছে।

২০১০ সালের দিকে RAB'রা আক্রমণ চালাইলো কম্পিউটারের দোকানগুলাতে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে শতশত মামলা জমা হইলো। তখন ব্যবসাটা একটু নিমাইয়া গেছিলো। তের সালের দিকে পুরাপুরি নিমাইয়া গেলো। হাতে হাতে স্মার্টফোন,ওয়্যারলেস ডাটা কানেকশান আর শেয়ার ইট এ্যাপ যুগান্তকারী পরিবর্তন আনলো।

ইন্টারনেট দুনিয়া হঠাৎ কইরাই ছড়ায়া গেলো। পিসিগুলা ভরতে লাগলো হাই রেজুলেশনের জৈবিক ভিডিওতে।
স্ট্যাটাস নির্মিত হইতো,কার কাছে কত হাই রেজুলেশনের ভিডিও আছে আর সংগ্রহকারীর স্ট্যাটাস নির্মিত হইতো কে কত বেশি ডাউনলোড সাইটের নাম জানে।

একটা বয়সের পর সবাই ইন্ড্রাস্টিয়াল থেইকা দেশী হ্যান্ডমেড ভিডিওতে ঝুঁকে। কারণ,ব্রয়লার আর দেশি মুরগির মাংসের স্বাদে বিস্তর ফারাক। রমজান মাস আসলেই দেশের লাখ লাখ পিসির হার্ডডিস্ক খালি হইয়া যাইতো। পোলাপাইনের মুখে ডিলিট করার সময়ে শোকের ছায়া। ইস মামা,ফুল এইচ ডি ছিলো..!!

কোনো একটা ফোনের দিকে দুই-তিনজনের একসাথে তাকায় থাকা মানেই উল্টাপাল্টা কিছু দেখতাছে। তথাকথিত এক বন্ধু বছর দুই আগে ল্যাপটপে সৃজনশীল ভিডিও দেখতেছিলো। হঠাৎ ঘরে মা'র প্রবেশ। বন্ধুবর হতচকিত হইয়া ডিসপ্লে বন্ধ করছিলো বটে কিন্তু তাতে সাউন্ড বন্ধ হয়নাই। সাউন্ডবক্সে ব্যাকগ্রাউন্ড প্লেব্যাক ঠিকই চলতেছিলো।

মা'র আর্তচিক্কুর,আমার পোলা নষ্ট অইয়া গেছে। সব নুরজাহানের পোলার দোষ..!!

যাহাই হউক,এরকম হাজারো ঘটনা রূপকথার মত দেশের আনাচে কানাচে ছড়ায়া আছে। চটি বই থেইকা শুরু কইরা তথ্য প্রযুক্তির উন্নতির ফলে ঘটনাপ্রবাহ পরিবর্তন হইছে,কিন্তু রূপকথার ভিডিও এখনও চলতেছে। কারণ,৯৮শতাংশ টিনএজ ই নিষিদ্ধ বিষয়ে বুদ্ধির বিকাশ ঘটায়।

অনেকে নাক সিঁটকায় ঠিকই তবে সেটা জনগণের দ্বিতীয় চরিত্র। তাদের মতে,"আমি ভালো মানুষ,এসব দেখা ঠিক না।"
আমি আবার দ্বৈত চরিত্রে বিশ্বাসী না। কেননা,একদা তান্ত্রিক বন্ধু শিখাইছিলেন,
"যোগাসন ই হোক আর যৌনাসন ই হোক,দুইটাই সুস্থ জীবনের উদ্দেশ্য।"

প্রত্যুত্তরে আমি বুঝিয়াছিলাম,
"সকল ক্রিয়াই কর্ম আর সেক্স ই জৈবিক ধর্ম।"

একজন সুখী রিক্সাওয়ালার গল্প


রাত ১২টায় চা খেতে বেড়িয়েছিলাম। হঠাৎ ইচ্ছে হলো,একটা সিগারেট নেয়া যাক;বহুমাস টানা হয়না। ফুঁকতে ফুঁকতে সামনে এগোচ্ছি,পিছন থেকে স্বর ভেসে এলো,

- টানতে না পারলে শুধু শুধু কিনেন ক্যান?

তাকাতেই দেখি একজন রিক্সাওয়ালা এগিয়ে আসছেন। বয়স চল্লিশের কাছে। হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে আগুনের দিকটা অদ্ভুত কৌশলে মুখে পুড়ে দিব্যি শেষ করে ফেললেন।

কিছুটা হতচকিত আমরা,অতঃপর গল্প শুরু।

গল্পে গল্পে তিনজনই গল্পের ভীড়ে হারিয়ে গেলাম। আমরা দুজন রিক্সার সিটে আর রিক্সাওয়ালা রিক্সার হ্যান্ডেলে বসে আছেন। গল্প চলছে। তার কৈশরে বিয়ের কাহিনী,বাড়ি থেকে সমুদ্রে যাওয়া,জাহাজ ভ্রমণ,চরান্ঞ্চলের খুনোখুনি,অবৈধ প্রেম আরো কত কি। তার এই পুরো জীবনটা নিয়ে তিনি বড়ই সুখী।

পুলিশের গাড়ি এসে টহল দিয়ে যায়,কিছু দূরেই আনসাররা বসে বসে আমাদের আড্ডা দেখছে। বেশ হচ্ছিলো। দুইঘন্টা গল্পের পর উনার পান খাওয়ার বাতিক উঠলো। আমাদের জোর করে রিক্সায় তুলেই উনি পানের উদ্দেশ্যে বের হলেন।

হঠাৎই নেমে এলো ঝুম বৃষ্টি।

একজন রিক্সাওয়ালা দুজন অচেনা ছেলেকে তার রিক্সায় নিয়ে মনের সুখে ঘুরে বেড়াচ্ছেন শহরের এমাথা থেকে ওমাথা। রিক্সার হুড খোলা,বৃষ্টির ফোটাগুলো যেনো এক একটা বরফের কনা।

আমি সুখী রাজকুমারের গল্প পড়েছি,কিন্তু একজন সুখী রিক্সাওয়ালাকে নিজের চোখে দেখেছি যে কি না তিনঘন্টা প্যাসেঞ্জার বহন বাদ দিয়ে দুজন ছেলেকে জীবনের গল্প বলেছেন।

গল্পের ওপারে এই মানুষটি আমাদের এতটাই পছন্দ করেছেন যে বিনে পয়সায় শহর ঘুরিয়ে বাসায়ও পৌঁছে দিয়ে গেলেন। পথিমধ্যে নিজে পান খাওয়ার সময় আমাদের চাও খাওয়ালেন।

প্রতিদিন নেশার মত এই নৈশভ্রমণ আমাদের যা দিচ্ছে তা হয়তো অন্যরা সারাজীবন খুঁজেও পাবেনা। কেননা,গল্পরা বোধহয় ঘরে থাকেনা। মহাসড়ক কিংবা গলির পথের ইটেয় ইটেয় ছড়িয়ে থাকে। একজন ২২বছরের আমি'র কাছে এর চেয়ে ভালো গল্প বোধহয় হয় না।

ঠিক করেছি,একদিন আমার উত্তরাধিকারীদের গল্প বলবো।

শতমাইল হাঁটার গল্প।

বয়ঃসন্ধির ডায়েরী


আজকের মত সেদিনও বৃষ্টি হচ্ছিলো। ঝিরঝিরে নয়,ঝুম বৃষ্টি। নিতান্ত সৌজন্যবোধের কারণেই দেখা করতে গিয়েছিলাম।

নিউমার্কেট রাস্তার মাঝ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি,আশেপাশের মানুষগুলো সব হাঁ হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কোনো মহানায়কের হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য নয় সেটা, কৈশোর পেরোনো সদ্য এক তরুণ ভারী বর্ষণে জুবুথুবু হয়ে হেঁটে চলেছে,ফিটফাট ড্রেসে,বিরক্ত ভঙ্গিতে।

রাস্তায় কোনো বাহন চলছেনা,এতটাই বৃষ্টি..!! আশেপাশের ফুটপাতে অগনিত মানুষ দাঁড়িয়ে আছে বৃষ্টি থেকে বাঁচতে। খানিকটা অস্বস্তি লাগছে,পাছে বোধহয় আমাকে উন্মাদ ভাবছে। কেউ কখনো ফিটফাট হয়ে বৃষ্টিতে ভেজে না।

নিউমার্কেটে কোন গেইট দিয়ে প্রবেশ করেছিলাম,খেয়াল নেই। তবে সে গেইটে তত মানুষ আশ্রয় নেয় নি। গেইটের নিচে বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছি,কাকভেজা হয়ে গেছি। ফোন,মানিব্যাগ সবকিছুতেই পানি ঢুকে গেছে। রুমালটা তাড়াহুড়োয় ফেলে এসেছি। রুমাল আর ঘড়ি ছাড়া কখনো বেড়িয়েছি বলে মনে পড়ছেনা। আজই এমন হলো..!!

হঠাৎ একখানা রুমাল বাড়িয়ে ধরলো কেউ। অতি ধবধবে ফর্সা একটা হাত সে রুমালটা ধরে আছে। হকচকিয়ে চেহারার দিকে তাকালাম,একজন অপ্সরী দাঁড়িয়ে আছে আমার পাশে। চিনতে পারলাম তাকে। একেই সৌজন্যবোধটুকু দেখাতে এসেছি আমি। স্বেচ্ছায় নয়,অনিচ্ছায়।

আশেপাশের লোকজন তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তাদের চোখে অদ্ভুত দৃষ্টি। হয়তো এই রূপসীর পাশে আমায় মানাচ্ছেনা।

বিব্রতকর অবস্থায় বেশ খানিকটা সময় পেড়িয়ে গেলো,তখনও রুমালটা আমার সামনেই ধরে রাখা হয়েছে।
- আমি আপনাকে বৃষ্টিতে ভিজে আসতে বলি নাই,ভিজে আসছেন কেনো?

- তুমি ই তো বললা,সময় নাই। ফেরার বাস ধরতে হবে। এতদূর থেকে আসছো,সৌজন্যবোধেরও তো একটা ব্যাপার আছে।

- সৌজন্যবোধ না,এটা কর্তব্য। সারা দুনিয়াতে ছেলেদেরই যেতে হয় মেয়েদের কাছে দেখা করতে,আপনার সেই ক্ষমতাও নাই।

- মেয়েদের কাছে কাছে গিয়ে দেখা করার অভ্যাস নাই আমার। আমি পারবোও না সেটা।

- তা পারবেন কেনো? সাহস থাকা লাগে তো সেসব করতে। বৃষ্টিতে ভেজানোর জন্য দুঃখিত। রুমালটা ধরেন,মাথা মোছেন।

- আমি অন্যদের রুমাল ব্যবহার করিনা।

- আমি নাক মুছিনা এই রুমাল দিয়ে,ঘেমে গেলে শুধু মুখ মুছি। ভয়ের কিছু নাই,ধরেন। মাথা মোছেন,ঠান্ডা লেগে যাবে।

রুমালটা হাতে নিলাম। ভারী মিস্টি একটা গন্ধ। খানিকটা মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম। হয়তো দ্বিতীয়বার তার গায়ের গন্ধ পেলাম..!!
- রুমালটা ফেরত দিন দয়া করে।

- মানে? নোংরা করে ফেলেছিতো মাথা মুছে। আমি চুলে জেল দেই। রুমাল তো আঠা আঠা হয়ে গেছে।

- কখনো তো কিছু দেন নাই,নোংরা হওয়া রুমালটাই ফেরত দিন দয়া করে? অন্তত আমার কাছে একটা স্মৃতি তো থাকুক..!!

আমি ভীষণ ভয় পাচ্ছি। প্রচন্ড সুন্দরীদের বরাবরই ভয় আমার। ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে,কিন্তু পা নড়ছে না। হয়তো মোহনীয় সৌন্দর্যের ফাঁদে পড়েছি।

- আমার খিদে পেয়েছে। রেস্টুরেন্টে চলেন।

- আমার কাছে টাকা নেই অত। রিক্সা ভাড়া ছিলো,শুধু সেটাই আছে।

- সেটা আপনার ভাবতে হবেনা। কখনো তো খাওয়ানও নাই,কিপ্টা কোথাকার। আসেন তো।

আমার হাত ধরে টান দিলো সে অপ্সরী,আমি প্রচন্ড বিব্রতকর অবস্থায় হাঁটছি তার পাশে। হাত ছাড়াতেও পারছিনা। হয় অতি ভয়ে,নয়তো আমিও চাইছিনা সে আমার হাত ছাড়ুক।
.
.
ঘন্টাখানেকের মত সময় কেটে গেলো। আমি এখনও সহজ হতে পারছি না। বসেছিলাম রেস্টুরেন্টের দোতলায়। ঝুম বৃষ্টির কারণে একজোড়া দম্পতি ছাড়া আর কেউ নেই।

আবেগপূর্ণ সে দম্পতি আমাদের প্রেমিক-প্রেমিকা ভেবে নিশ্চিন্তে নিজেদের চুমুর রাজ্যে ডুবিয়ে রেখেছেন। অপ্সরী সেদিকে তাকাচ্ছে আর আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।

হঠাৎ নিজের হাতে আরেকটা মোলায়েম হাতের স্পর্শ টের পেলাম। আমার হাতে বেশ রকমের টাকা গুঁজে দিলো সে।
- বিল টা দিয়ে দেবেন। আর একটা কথা,আশায় থাকবো। আমি যদি ভাগ্যবতী হই,হয়তো কোনোদিন কেয়ার পাবো।

সাথে সাথেই এক মিষ্টি চুম্বন অনুভব করলাম। সেকেন্ডের ক্ষণস্থায়ী সে চুম্বন দিয়েই অপ্সরী দৌঁড়ে নিচে নেমে গেলো। আমি মোহময়ীর গন্ধে মোহাচ্ছন্ন হয়ে রয়েছি।
.
.
ঘন্টাখানেক পরে বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে। বৃষ্টি থেমে গেছে। রাস্তা সেই চিরচেনা ব্যস্ততায় ফিরে গেছে।
সেদিনের মত আজও ঘোরলাগা চেতনায় হাঁটছি আমি,হয়তো সেটাই প্রথম ছিলো না। ছেলেদের চরিত্র মেঘের মত বদলায়।

সে মিষ্টি গন্ধ টা আজও খুঁজি। নেশার জন্য নয়,আকুতির জন্য। আর কখনো দেখা হয় নি আমাদের,হবেও না। দুই পৃথিবীতে আছি আমরা।

যোগাযোগের কোনো চেষ্টা করবো না। যদি কখনো সম্ভব হয়,তোমার ব্যবহার করা একটা রুমাল পাঠিয়ে দিয়ো ওপার হতে। আমি যত্ন করে রেখে দেবো।

ডেঙ্গীর চুম্বন


কোনো এক মেঘার্ত-সকালে যখন কলেজে না গিয়া লেপমুড়ি দিয়া মহাসুখে নিদ্রায় আছি ঠিক,তখনি যদি ফোনে রিং বাজিয়া উঠে,আর কল ধরিবামাত্রই ওপাশ থাকিয়া কোন এক কন্যা বলিয়া উঠে,

- হ্যালো আব্বা,কই তুমি?

আমি তড়াক করিয়া লাফাইয়া উঠিয়া চতুর্পাশে তাকাইয়া তৎক্ষণাৎ বুঝি,নহে,আমি অদ্যবধি অবিবাহিতই রহিয়াছি। আমার কোনো কন্যা নাই আর থাকিলেও তাহা স্মরণে নাই। জ্ঞানীদের আবার স্মরণশক্তি বেজায় কম থাকে।
সুতরাং,ফোন কাটিয়া পুনরায় লেপমুড়ি নিশ্চিন্তে দেওয়া যায়।

পশ্চাদদেশে সর্বদা নাকি সুখ সয় না। স্বয়ং তের তলায় আসিয়াই ডেঙ্গী হুল ফুটাইয়া গেলো। বেগানা মশকীর চুম্বনে দেহখানায় যখন যৌবনের স্রোত বহিতেছিলো,পিতা আমারে উঠাইয়া নারায়ণগঞ্জে নিয়া আসিলেন।

আট-দশদিন কোন ফুটা দিয়া উবিয়া গেলো,টেরই পাইলাম না। চোখ মেলিতেই দেখি সামনে স্যালাইনের ব্যাগ ঝুলিতেছে। মাঝে মাঝে দুপুরে জ্ঞান ফিরিলে টের পাইতাম,আমার একমাত্র মুখপানে যেন আরও দশখানা মুখ হাঁ করিয়া চাহিয়া আছে।

ডেঙ্গু হইয়াছে,কম কথা নহে..!!

কেহ কেহ অতি উৎসাহে আঙ্গুরের পরিমাণ দুই কেজিতে তুলিয়াছে। বলা যায় না,কাজেও লাগিতে পারে। রোগীর অন্তিমকালে আঙ্গুরের জুড়ি মেলা ভার।

নারায়ণগঞ্জ আবার "হাত বাড়াইলেই শাবনূর" টাইপের শহর। দেউড়িতে দাঁড়াইয়া হাঁক পাড়িলে চৌষট্টি জেলারই বাসিন্দার দেখা পাওয়া যায়। অচেতনাবস্থায় কোনো এক খালাকে বলিতে শুনিয়াছিলাম,
- আই উ মা গো,আমরার ফুতটারে গতবছর কি জ্বালানডাই না দিলো গো...!!

তৎক্ষণাৎ ফোঁসফোঁস সুরে আরেক কন্ঠ ভাসিয়া উঠে,
- আঁর কি মনে অয় ফাহিমোর মা,ছেম্রাডার মাইট্যা জন্ডিস অইছে। অ সিফাতোর মা,মাডি পড়া আইন্যা দিমু নি?

এলাকার মুরুব্বী পুরুষগণ সে তুলনায় বেশ সাহসী। বাতের ব্যাথায় নিজদিগের হাড্ডি একপাশে সড়াইয়া দিব্যি উপদেশ দিতেছেন,
- চিকুনগুনিয়া? এ আর এমন কি..!! স্যালাইন খা।

- টাইফয়েড অইছে? এ আর এমন কি..!! স্যালাইন খা।

- ডেঙ্গু অইছে? এ আর এমন কি..!! স্যালাইন খা।

সম্ভবত শেষ পর্যায়ে এরূপও হইতে পারিতো,
- এইডস অইছে? এ আর এমন কি..!! স্যালাইন খা।

সারারাত রাস্তায় ঘুরিলাম,বৃষ্টিতে ভিজিলাম,সাইকেল চালাইয়া ঘর্মাক্ত হইলাম,কিচ্ছুটি হইলো না। বেগানা এক মশকীর কামড়ে দেহখানা যেন লাড়া দিয়া গেলো।

এরেই বুঝি কহে,হাতি ঘোড়া গেলো তল,মশা কয় কত জল?

যাহাই হউক,আগামীকল্য প্রত্যাবর্তন করিতেছি। বিগত একমাস কলেজমুখো হইনাই। বাসায় ঘুমাইয়াছি। ভয় ছিলো,না জানি টিসি দিয়া দেয়। এখন আর সে ভয় নাই।

সঙ্গে হপ্তাখানেক আগের ডেঙ্গু আর চিকুনগুনিয়ার সার্টিফিকেট আছে। ঠিকঠাকমতো ফিটিং মারিতে পারিলে আরও একমাস ঘুমোনোর বন্দোবস্ত করা যায় বৈ কি..!!


বি.এম.আই নিয়ে যত কথা

বি.এম.আই (B.M.I)

পরিপূর্ণ নাম "Body Mass Index" বা "দেহের ওজন সূচক।"
একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দেহের ওজন মাত্রাতিরিক্ত কিনা তা নির্ণয়ের জন্য উচ্চতা ও ওজনের যে আনুপাতিক হার উপস্থাপন করা হয় তাকে বি.এম.আই বলা হয়।

মূলত,শরীর-স্বাস্থ্য কোন অবস্থায় আছে তা বোঝার জন্য দু'টো পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।

১.সঠিক ওজন নির্ণয়

২.বি.এম.আই নির্ণয়

প্রথমটি নির্ণয় অপেক্ষাকৃত সহজ। আদর্শ ওজন এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে। আদর্শ ওজন হচ্ছে সেটাই যেখানে ব্যক্তির উচ্চতার তুলনায় ওজন কতখানি আছে তার পরিমাপ।

নির্ণয়ের সূত্রটি হচ্ছে-
আদর্শ ওজন= উচ্চতা(সে.মি)-১০০

উদাহরণস্বরূপ,কারো উচ্চতা ৫'৫"=৬৫"=৬৫×২.৫৪ সে.মি=১৬৫.১ সে.মি  [যেহেতু,১"=২.৫৪ সে.মি]

সুতরাং,আদর্শ ওজন= ১৬৫.১-১০০= ৬৫.১ কিলোগ্রাম

সূত্রটি প্রয়োগ করে যদি কোনো ব্যক্তির আদর্শ ওজন আর মাপার পর প্রাপ্ত ওজনে বেশখানেক পার্থক্য ধরা পড়ে,তখন বুঝতে হবে ঐ ব্যক্তির শারীরিক ভারসাম্যহীনতা আছে।

তবে এ পদ্ধতিটি শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্ক অর্থাৎ ১৮ বছরের বেশি হলেই প্রয়োগ করা যাবে।

ওজনের ব্যাপার তো গেলো।

সঠিকভাবে ওজন নির্ণয় দ্বারা স্বাস্থ্য স্বাভাবিক অবস্থায় আছে কি না তা বোঝা গেলেও যদি ফলাফলের পার্থক্য খুব বেশিই হেরফের হয় তখন স্বাস্থ্য টা আসলেই কোন পর্যায়ে আছে তা নির্ণয়ের জন্য বি.এম.আই প্রয়োগ করতে হয়।


সূত্রটি হলো-
বি.এম.আই= কেজি'তে ব্যক্তির ওজন÷মিটারে ব্যক্তির উচ্চতা²

ধরা যাক,কোনো ব্যক্তির ওজন ৭০ কেজি এবং উচ্চতা ৫'৭"
এ ক্ষেত্রে প্রথমেই উচ্চতাকে মিটারে রূপান্তরিত করতে হবে।
৫'৭"= ৬৭"= ৬৭×২.৫৪ সে.মি = ১৭০.১৮ সে.মি= ১.৭ মিটার
সুতরাং,বি.এম.আই= ৭০÷১.৭²
                            = ২৪.২২

এ সূত্রটি সর্বাধিক ব্যবহৃত হলেও এ পদ্ধতি ব্যতীত আরেকভাবেও মাপা যায়। সে ক্ষেত্রে ওজনকে পাউন্ড আর উচ্চতাকে ইন্ঞ্চিতে ধরা হয়।

বি.এম.আই গণনার পরবর্তী কাজই হলো ফলাফলটি তালিকার সাথে মিলিয়ে দেখা এবং ব্যক্তির স্বাস্থ্য কোন পর্যায়ে আছে তা নির্ণয় করা।
বি.এম.আই              ক্যাটাগরি
--------------           ------------
<১৮.৫০               ওজনহীনতা
১৮.৫-২৪.৯           স্বাভাবিক
২৫.০-২৯.৯           ওজনাধিক্য
৩০.০-৩৯.৯          স্হূলতা
>৪০.০                  চূড়ান্ত স্হূলতা

যদিও এক এক দেশে বি.এম.আই এর চার্ট এক এক রকম হয়,কেননা ভৌগলিক পরিবেশ,খাদ্য গ্রহণ,দেহাকৃতি স্হানভেদে ভিন্ন হয়।

বলে রাখা ভালো যে,এ ক্ষেত্রেও উপর্যুক্ত তালিকাটি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রযোজ্য।

শিশুদের ক্ষেত্রে (২-২০ বছর) একই সূত্র প্রয়োগ হলেও স্বাস্থ্যের পর্যায় নির্ণয়ের তালিকাটি ভিন্ন। একটি নির্দিষ্ট সীমার ভেতর শতকরা হারের মাধ্যমে সাধারণত নির্ণয় করা হয়। শতকরা হার ৫% এর নিচে হলে ওজনহীনতা,৫-৮৫% হলে স্বাভাবিক,৮৫-৯৫% হলে ওজনাধিক্য এবং ৯৫% এর বেশি হলে স্থূলতা।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বি.এম.আই এর পাশাপাশি কোমর ও নিতম্বের মাপের অনুপাত দিয়েও স্থূলতা নির্ণয় করা হচ্ছে।
আদর্শ অনুপাত= কোমরের মাপ(সে.মি)÷নিতম্বের মাপ(সে.মি)
আদর্শ ফলাফল:
পুরুষদের ক্ষেত্রে <০.৯
মহিলাদের ক্ষেত্রে <০.৮
প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ: ১৯৮০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৩৩ বছরের পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, ১৯৮০সালে ৭% প্রাপ্তবয়স্ক এবং ৩% শিশু ওজনাধিক্য বা স্হূলতায় আক্রান্ত হলেও ২০১৩ সালে তা দাঁড়ায় ১৭% প্রাপ্তবয়স্কে কিন্তু ৪.৫% শিশুতে। দেখা যাচ্ছে যে,স্হূলতা ২% থেকে ৪% এ বেড়ে দাড়িয়েছে প্রাপ্তবয়স্কদের;অন্যদিকে তা শিশুদের ক্ষেত্রে ১.৫%
অর্থ্যাৎ,প্রাপ্তবয়স্করা শিশুদের তুলনায় দিন দিন অধিক আক্রান্ত হচ্ছেন।
দেখা যাক কারণগুলো-
১. কায়িক পরিশ্রম না করা,একটানা বসে থেকে কাজ করা।
২.অপরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য গ্রহণ না করা,চর্বিযুক্ত ও চিনিযুক্ত খাদ্য গ্রহণ,অ্যালকোহল পান।
৩. বিষন্নতা,আশাহীনতা,রাগ কিংবা একঘেয়েমিতে অতিভোজন।
৪. নিদ্রাহীনতায় হরমোনজনিত পরিবর্তনে ক্ষুদাগ্রতা বাড়ায় অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহন।
৫. বংশগত কারণেও স্হূলতার সৃষ্টি হয়।
৬. পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম,কুসিং সিনড্রোম,হাইপারথায়রয়েডিজমে আক্রান্ত হলে স্হুূলতা দেখা দেয়।
৭. অ্যান্টিডিপ্রেজেন্টস কিংবা জন্মবিড়তিকরণ বড়িও স্হূলতার কারণ।
৮. সুস্বাস্থ্য এবং সুষম খাদ্য সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব।
বি.এম.আই এর বিভিন্ন অবস্থার ফলাফল:
বি.এম.আই অতি কম হলে ওজনহীনতার সৃষ্টি হয়। ফলে রুগ্নতা,চেহারায় বলিরেখা,রক্তশূণ্যতা,শারীরিক দূর্বলতা,চর্মরোগ,চুল পড়া,দাঁত নস্ট হয়ে যাওয়া এবং হাড়ের ক্ষয় ঘটে।
আবার,বি.এম.আই অত্যধিক হলে ওজনাধিক্য কিংবা স্হূলতা সৃষ্টি হয়। ফলে হৃদরোগ,ডায়াবেটিস,স্তন ও কোলন ক্যান্সার,উচ্চ রক্তচাপ,স্ট্রোক,ডিজলিপিডেমিয়া,শ্বসনতন্ত্র-যকৃত-পিত্তথলির অসুখ এবং বন্ধ্যাত্ব দেখা দেয়।
মূলত চর্বির কারণেই স্হূলতার সৃষ্টি। পেটে,নিতম্বে,কোমরে চর্বিকোষ বেশি থাকে। তবে চর্বির বিতরণের উপর নির্ভর করে ঝূঁকিপূর্ণতা নির্ণয় করা যায়। দেহের আকার আপেল আকৃতির হলে তা অধিক ঝূঁকিপূর্ণ অন্যদিকে নাশপাতি আকৃতির হলে কম ঝূঁকিপূর্ণ। দেহের অন্যান্য অংশের তুলনায় পেটে জমাকৃত চর্বি (সেন্ট্রাল এদিপসিটি) অনেক বেশি বিপদজনক।
প্রতিকার: সুষম খাদ্য গ্রহণ,নিয়মিত ব্যায়াম,আবেগ নিয়ন্ত্রণ,কায়িক পরিশ্রম এবং পরিপূর্ণ নিদ্রা-ই যথেষ্ট স্হূলতা দূর করতে।
অনেক সময় দেখা যায় যে,সঠিক পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করলেও ওজনাধিক্যের সৃষ্টি হচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে,যে পরিমাণ ক্যালরি দেহ গ্রহণ করছে সে পরিমাণ খরচ করছেনা। ফলে মেদ জমা হচ্ছে। আবার অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ করেও দেহের রুগ্নতা সারছে না। এর কারণ হচ্ছে,দেহের যে পরিমাণ ক্যালরি দরকার সে পরিমাণ পাচ্ছেনা। এমতাবস্থায়,চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
তবে নিয়মমাফিক জীবনযাপন করলে স্বাভাবিকভাবেই ফিটনেস বজায় রাখা যায়। মনে রাখতে হবে,
"স্বাস্থ্য সকল সুখের মূল নয়,সু-স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল।"




লেখকঃ মুয়িদুল ইসলাম সিফাত 
Green Life Medical College and Hospital
Dhaka-1205,Bangladesh
Batch: GMC-7

পোস্টটির দর্শক সংখ্যা-

ফিচার পোস্ট

দারুণ তিনটি টিনেজ মুভি

কৈশোরেতে প্রেমে না পড়লে বুড়ো বয়সে আপসোস করতে হয়। বয়ঃসন্ধির নতুন জগৎ,নতুন অনুভূতি,ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো পরবর্তীতে দারুণ স্মৃতি হয়ে আজীবন রয়ে যায়...

সর্বাধিক পঠিত